প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর, ২০২১ ১৪:০৯ (শনিবার)
সুদৃঢ় হোক সম্প্রীতির  সাম্প্রদায়িক বন্ধন

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলতে বোঝায়-সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে প্রীতি। জাতি-গোষ্ঠীতে সংহতি ও সুসম্পর্ক। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষে মানুষে মিল-মহব্বত।

দল-মত ও শ্রেণির অধিকারপূর্ণ সহাবস্থান। লঘু-গরিষ্ঠের পরিচয় থেকে বেরিয়ে নাগরিকে নাগরিকে আন্তঃমিল। মিলেমিশে বসবাস।

ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম। সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। জুলুম-নির্যাতন ও কলহ-বিবাদকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। ব্যক্তিগত জুলম-অবিচার যেমন হারাম তেমন দলে দলে, দেশে দেশে বরং আদর্শে আদর্শে সহিংসতাও হারাম।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় ইসলাম মানুষের বোধ-বিশ্বাস থেকে সব ধরনের বিভক্তি তুলে দিয়ে একমাত্র ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ থিওরি দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সব মানুষ ছিল একই জাতিভুক্ত। এরপর আল্লাহতায়ালা নবি পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসাবে’। (বাকারা : ২১৩)। অন্য আয়াতে রয়েছে-‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার’। (হুজুরাত : ১৩)।

ইসলাম ধর্মে ‘সম্প্রদায়’ মানুষের একটি সাধারণ পরিচয়। তাও শুধু পরিচয়ের জন্য। নতুবা তার প্রধান পরিচয় সে মানুষ। আদম সন্তান। নবিজি বলেন, ‘সব মানুষই আদমের বংশধর, আর আদম মাটি থেকে তৈরি’। (তিরমিজি)।

জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, গোষ্ঠী-জ্ঞাতি, ভাষা ও দেশের মুখ্য পরিচয় তুলে দিয়ে ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে-‘তোমরা সবাই আদম সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। একমাত্র তাকওয়া ছাড়া অনারবদের ওপর আরবদের আর আরবদের ওপর অনারবদের কোনো প্রাধান্য নেই’। (বাইহাকি)। ইসলামে ধর্মীয় উন্মাদনা, জবরদস্তি ও চাপাচাপি জায়েজ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দ্বীনের মধ্যে জবরদস্তি নেই’। (বাকারা : ২৫৬)। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য। আমাদের দ্বীন আমাদের জন্য’ (কাফিরুন : ৬)।

অন্য ধর্মের অবমাননা, সমালোচনা ও নিন্দা ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে’। (আনআম : ১০৮)।

ধর্মীয় বিবেচনা কেন, সব সময় জুলুম-অবিচার ইসলামে হারাম। এ ক্ষেত্রে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নবিজি বলেন, ‘জুলুম-অবিচার কেয়ামতের দিন অন্ধকারের রূপ নেবে’। (বুখারি ও মুসলিম)।

সাম্প্রদায়িকতার মূলে কঠোর আঘাত হেনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের ন্যায়বিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার করবে। ইনসাফ করবে। এটাই তাকওয়া’। (মায়িদা : ৮)।

ঐতিহাসিক ‘মদিনার সনদ’ ইসলামে অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বাস্তব নমুনা। পৌত্তলিক, ইহুদি-খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের সমন্বিত ‘মদিনা রাষ্ট্র’ তাবৎ পৃথিবীর আদর্শ। যার নজির আধুনিক বিশ্বে পাওয়াও অসম্ভব। ইসলাম হাতে-কলমে পুরো মানব জাতিকে অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের কারিকুলাম ও ফর্মুলা দিয়েছে এ মদিনার সনদের মাধ্যমে।

ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু-গরিষ্ঠের কোনো ভেদাভেদ নেই। মুসলিম-অমুসলিমের পরিচয়ও এখানে গৌণ। বরং নাগরিক হিসাবে সবার দায়িত্ব ও অধিকার সমান। নবিজি বলেন, ‘তারা তাই পাবে আমরা যা পাই। তাদের সে দায়িত্ব আমাদের যে দায়িত্ব’। (বাইহাকি)।

উপরন্তু অমুসলিম নাগরিকদের অতিরিক্ত অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলামের দিকনির্দেশনা-নবিজি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না; অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়’। (বুখারি)।

অপর হাদিস শরিফে আছে-‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে, অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা তার ওপর সাধ্যাতীত কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা জোর করে তার সম্পদ নিয়ে যায়-তবে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে বিবাদী হব’। (আবু দাউদ)।

ইসলাম সম্ভব সব পন্থায় সমাজ ও ব্যক্তি থেকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ উৎখাতে বেনজির ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় আজও যদি ইসলামের দীক্ষা ও দিকনির্দেশনার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও বাস্তবায়ন করা যায়, তবে সাম্প্রদায়িকতা দূর হতে সময়ের ব্যাপার মাত্র। আল্লাহ আমাদের বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন।