
মানুষের মধ্যে আবেগ অনুভূতি বেশিরভাগ সময় প্রকাশ করে থাকে তার পিছনে ফেলে আসা স্মৃতি থেকে। আর স্মৃতি মানেই আনন্দ বেদনার মিশ্রণ। আমি আনন্দের স্মৃতিগুলো সুন্দর করে মনে রেখে দেই আর বেদনার স্মৃতি ভুলে যাওয়ার বেহাত চেষ্টা করি। আবার স্মৃতি যাইহোক ভুলে যাওয়া কষ্টকর! কেননা আমাদের মস্তিষ্কের বেশি পরিশ্রম করতে হয় অতীতে ঘটে যাওয়া কোন মুহূর্তকে ভুলে যেতে। বিপরীতে কোন কিছু মনে করতে মস্তিষ্ককে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। তেমনি আজ শৈশবের এক আনন্দময় স্মৃতির কথা প্রকাশ করব।
আমি মনে করি এই স্মৃতি শুধু আমার একারই নয়, যারা পড়ছেন তাদের বেশিরভাগই এই স্মৃতির মুহূর্তটা অনুভব করে এসেছেন। এই যেমন, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কখনও কান পেতে শুনেছেন? যদি শুনে থাকেন অর্থাৎ উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আশাকরি অবশ্যই উপভোগ্য একটা সময় অনুভব করতে পেরেছেন।
গ্রামের বাড়িতে জন্ম আমার। টিনের চালাঘরের বাড়ি আমাদের। সেখানেই আমার শৈশব ও কৈশোর কাল কেটেছে। শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলে এক কলামে লিখে শেষ হওয়ার মতো না। সুতরাং ঐদিকে এখন আর বাড়াচ্ছি না ! চলে আসি বৃষ্টির দিনে টিনের চালে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দের স্মৃতির মুহূর্ত উপস্থাপন করতে।
বৃষ্টির ফুটো যখন টিনের চালে এসে পড়ে তখন টিনে মধ্যে একটা তীব্র ধ্বনি সৃষ্টি করে। টিপ টিপ শব্দ, ঝিরি ঝিরি হাওয়া। টিনের চালে বৃষ্টির টিপ টিপ শব্দ এসে পৌঁছায় আমাদের শ্রুতিপথে, শ্রুতিপথ থেকে মন মস্তিষ্কে। মন মস্তিষ্ক নিয়ে যায় চিন্তাভাবনায়, চিন্তাভাবনা থেকে নিয়ে যায় স্বপ্নের দেশে। মজার বিষয় হচ্ছে, লেখাটি যখন লিখছিলাম সেদিন আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঈদের ছুটিতে। রাত এগারোটা হবে, বাহিরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি আসতেই টিনের চালের শব্দ মনে করিয়ে দেয় পূর্বকার দিনের স্মৃতিগুলো। সেই চিন্তা থেকেই লেখা শুরু।
এক পর্যায়ে আমি লিখতে শুরু করি। লিখতে লিখতে টিনের চালে বৃষ্টির ফুটোর শব্দে চলে যাই ভাবনায় জগতে। আর সেই ভাবনার জগৎ থেকে যে কখন নিদ্রায় চলে যাই বলতেই পারিনি। নিদ্রা থেকে জেগে উঠে মুঠোফোনের ঘড়িতে সময়ের দিকে চেয়ে দেখি সময় তখন রাত তিনটা হয়ে গেছে! মনে হলো অনেকদিন পর একটা তৃপ্তির ঘুম দিয়েছি। পাশাপাশি একটা চমৎকার রঙিন স্বপ্নও দেখেছি। মানুষ বাস্তবে যা কল্পনা করে ঘুমের রাজ্যের স্বপ্নেও প্রায় সেটার প্রতিচ্ছবি আসে। ঘুম ভাঙার পর আবার চলে আসি টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার স্মৃতিচারণ করতে।
বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে। আর তখন বর্ষা মৌসুমে বাড়ির চতুর্দিকে পানি থই থই, পানি যেন ঘর ছুঁই ছুঁই। প্রায় ঘরবন্দি জীবন তখন! তবে বর্ষাকাল আমার কাছে পছন্দের একটা ঋতু। তবে এটাও সত্যি যে সারাদিনের মেহমানি বৃষ্টি আমার ভালো লাগে না। দিনে ঘুরাঘুরি করতে হবে, এছাড়াও অনেক কাজ থাকে দিনে! বৃষ্টি হোক রাতে। সুতরাং আমার কাছে দিনের বেলার বৃষ্টির চেয়ে রাতের বৃষ্টি বেশি উপভোগ্য। তবে বর্ষাকাল আমার কাছে যেমন পছন্দের তারচেয়ে বেশি পছন্দের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে আমার মনকে বিমোহিত করা মুহূর্তটা।
বৃষ্টি আসার আগ মুহূর্তে দিগন্তজোড়া ঘন কালো মেঘে ভরা আকাশ আমাকে হারিয়ে যেতে আহ্বান করে অদূরে। অপেক্ষায় থাকি কল্পনারাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য যে কখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়বে আমার ঘরের টিনের চালে আর আমি হারিয়ে যাব প্রকৃতির সৌন্দর্যে। টিনের চালের উপর বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ, এ যেন এক মনন মাঝে অনন্য অনুভূতির খনন। আর তখন সেই বৃষ্টির শব্দ আমাকে আরো আনন্দিত করে তুলতো। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতে আমার খুব ভালো লাগে। তেমনি বৃষ্টি দেখতেও ভালো লাগে, আর সেই টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আমার মনকে উৎফুল্ল করে তোলে। যখন টিনের চাল বেয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ে তখন শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। তখন যেন মনে হয় এ এক প্রাকৃতিক ঝর্ণা। তখন সেই ঝর্ণায় আমি না ভিজলেও আমার মন ভিজতে থাকে , উপভোগ হয় প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালের শব্দ। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির সাথে কিছুটা আলিঙ্গনের চেষ্টা।
যদিও টিনের চালে পড়া বৃষ্টির শব্দে প্রচণ্ড ভাবে ঘুম চেপে ধরে, কিন্তু ঘুমালে টিনের চালে পড়া বৃষ্টির শব্দ মনোযোগ দিয়ে শোনা হবে না, অনুভব করা হবে না খোলা আকাশে বৃষ্টির আন্দোলিত হওয়া। তাই জোর করে চোখ খোলা রাখা। তবে ঘুমিয়ে গেলেও তৃপ্তির একটা ঘুম দেওয়া যেতো। কোনোরকমে যদি কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শোয়া যায় কখন যে চোখে নিদ্রা চলে আসে বলাই যায় না। কল্পনা করতে করতেই চলে যাওয়া স্বর্গীয় নিদ্রায়।
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের স্মৃতির সাথে শৈশবের আরও কিছু স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এইযে যেমন বৃষ্টি হলেই মা বাদাম ভাজতেন, ছোলা ভাজতেন, শিমের বিচি ভাজতেন ও মুড়ি মাখানো হতো সবাই মিলে খেয়ে সময় কাটানোর জন্য। আর এছাড়াও বৃষ্টির দিনে ভাজা পোড়া খেতে একটা আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়। বৃষ্টিময় দিনে যখন ঘরবন্দি তখন সবাই মিলে খাতায় মধ্যে চুর পুলিশ খেলতাম , ক্যারম বোর্ড খেলতাম, লুডু খেলতাম। রূপকথার গল্প করতাম, গল্প শুনতাম। আজ এসব শুধুই স্মৃতি!