
ছবি: আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা
বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন শব্দ দুটি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। কোয়ারেন্টিনের প্রথম আবিষ্কারক হলেন খ্যাতিমান মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। তিনিই প্রথম কোয়ারেন্টিনের ধারণা মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
ইবনে সিনার মতে, কিছু রোগ নিশ্চিতভাবে মাইক্রোঅর্গানিজম দ্বারা ছড়ায়। তাই মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করতে তিনি ব্যবস্থাপত্রে নির্দেশনা লেখেন—সংক্রমিত ব্যক্তিকে ৪০ দিন একেবারে আলাদা করে আইসোলেশনে অর্থাৎ নির্জনে রাখতে হবে। এর দ্বারাই সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব হবে। তাঁর ওই ধারণাই হলো বর্তমানের কোয়ারেন্টিন চিকিৎসা পদ্ধতি। তিনি ওই পদ্ধতির নাম রেখেছিলেন আল-আরবানিয়া অর্থাৎ ৪০ দিন নির্জনে থাকা। তাঁর প্রবর্তিত এ কোয়ারেন্টিন পদ্ধতি ভেনিস ও ইতালির বাণিজ্য দলের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছেছিল। ইতালিয় ভাষায় যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কোয়ারান্ট’। ইংরেজিতে এটি উচ্চারিত হয় ‘কোয়ারেন্টিন’।
ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্রের অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রায় ১৮ দশকের শেষ পর্যন্ত ৭০০ বছর ধরে তাঁর লিখিত বইগুলো অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হতো।
উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি থাকতেন। এই দার্শনিকের জন্ম আনুমানিক ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে। পুত্রের জন্মের কিছুকাল পরেই পিতা আবদুল্লাহ তাঁকে বোখারায় নিয়ে আসেন। সে সময় বোখারা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্র। শিশুপুত্রের মেধাদীপ্ত কথাবার্তায় পিতা বুঝেছিলেন, এ ছেলে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করবে। ইবনে সিনার মেধা ছোটবেলা থেকেই সবার নজর কাড়ে এবং তাঁকে তখনকার সময়ের বিস্ময় হিসেবে ধরা হয়।
মাত্র ১০ বছর বয়েসে ইবনে সিনা পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। ছেলের এই সাফল্য দেখে বাবা ছেলের জন্য তিনজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তাঁর বয়স যখন ১৭ বছর, তখন সেই সময়ের প্রচলিত সব জ্ঞান লাভ করে ফেলেন তিনি। বিখ্যাত দার্শনিক আল নাতেলি ইবনে সিনাকে সব বিষয়ে জ্ঞান দান করেন। ইবনে সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। চিকিৎসার মাধ্যমে দুস্থ মানবতার সেবা করার জন্য মনস্থির করেন। তাই তিনি চিকিৎসা বিষয়ক যাবতীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করেন।
একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে সর্বত্র ইবনে সিনার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জটিল রোগের চিকিৎসায় সাফল্য লাভ করেন। বোখারায় তখন বাদশাহ ছিলেন নূহ বিন মনসুর। তিনি একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। ইবনে সিনার সুখ্যাতি শুনে বাদশাহ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ইবনে সিনার চিকিৎসায় অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। বাদশাহ ইবনে সিনার ওপর খুবই সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী পেলে খুশি হবেন? উত্তরে তিনি বললেন, জাহাঁপনা লাইব্রেরির সব বই যদি আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিতেন, তবে সেটাই হবে আমার পরম পাওয়া। ইবনে সিনার আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রবল। তিনি ধন সম্পদের লোভ করতেন না। বরং জ্ঞান অর্জনই ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য।
গজনীর সুলতান মাহমুদ সে যুগে মহাপ্রতাপশালী বাদশাহ ছিলেন। সুলতান মাহমুদ জ্ঞানী, গুণীদের খুবই পছন্দ করতেন। তিনি তাঁদের দরবারে স্থান দিতেন। সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনার ৪০টি প্রতিকৃতি তৈরি করে ইরান ও এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে পাঠান। যাতে ইবনে সিনার সন্ধান পাওয়া যায়। ইবনে সিনা ছিলেন খুবই স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি গজনবীতে গেলে হয়তো স্বাধীনভাবে সম্মানের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারবেন না। এই ভয়ে তিনি সেখানে যেতে চাননি। খাওয়ারিজমে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তিনি ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দে অনিশ্চিতের পথে যাত্রা শুরু করেন। অবশেষে গুরগাঁও গিয়ে থিতু হন। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করতে থাকেন।
তবে রাজনৈতিক কারণে কোনো একস্থানে বেশি দিন থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশেষে গেলেন রাও প্রদেশে। কিন্তু তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি ও মর্যাদা দেখে রাজার সভাসদদের অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এতে বিরক্ত হয়ে তিনি প্রথমে কাজভিন এবং পরে হামাদান শহরে যান। হামাদানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানকার বাদশাহ শামস-উদ দৌলা সে সময় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন। ইবনে সিনা ৪০ দিন চিকিৎসা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। এরপর নিজের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হামাদানের রাজনীতিতে তিনি জড়িয়ে পড়েন। তিনি বাদশাহ শামস-উদ দৌলার অনুরোধে তাঁর মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
বাদশাহ শামস-উদ দৌলার মৃত্যুর পর মন্ত্রিত্ব ছেড়ে ইরানের একটি প্রদেশ ইস্পাহানে চলে যান তিনি। সে সময় ইস্পাহানের শাসক ছিলেন আলা-উদ দৌলা। তিনি ইবনে সিনাকে পেয়ে খুশি হন। ইবনে সিনার জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন। ইবনে সিনা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আশশেফা ও আল কানুনের অসমাপ্ত লেখা সেখানেই শেষ করেন। আল কানুন গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দেয়। ইউরোপের মেডিকেল কলেজগুলোতে আল কানুন গ্রন্থটি বহুকাল পাঠ্য ছিল। গ্রন্থটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। ‘আল কানুন ফিল তিবব’ (Canon of Medicine) ১৯৭৩ সালে নিউইয়র্কে পুনর্মুদ্রণ হয়।
ইবনে সিনা চিকিৎসা শাস্ত্রে অবদানের জন্য পরিচিত হলেও তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ ছিল। খুব কমসংখ্যক লোকেই জানেন যে ইবনে সিনা জড়তা সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছিলেন তা নিউটনের জড়তার ধারণা থেকে কোনো অংশে কম নয়। ইবনে সিনা ভার্নিয়ার স্কেলের মতো একটি স্কেলের উদ্ভাবন করেন যা থেকে ক্ষুদ্রতম অংশ পরিমাপ করা যেত। তিনি কয়েকটি জ্যোতিষ্ক-বিক্ষণাগার স্থাপন ছাড়াও হামাদানে কয়েকটি মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। গণিতশাস্ত্রেও তাঁর অবদান ছিল অসাধারণ।
সারা জীবন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অবস্থান করে শেষ জীবনে তিনি ফিরে আসেন ইরানের হামাদানে। দিনের পর দিন গবেষণার কাজে তিনি ব্যয় করেছেন। এ কারণে তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ সময় তিনি পেটের রোগে আক্রান্ত হন। একদিন তাঁর এক কর্মচারী ওষুধের সঙ্গে আফিম মিশিয়ে দেন। পরে বিষক্রিয়ায় তাঁর জীবনী শক্তি শেষ হয়ে আসে। ১০৩৭ সালে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই জনক ইবনে সিনা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। হামাদানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।